সমস্ত লেখাগুলি

বক্সা পাহাড়ে আর পড়াশোনা হবে না, বন্ধ হল সবকটি স্কুল -
লাল সিং ভুজেল
Dec. 3, 2024 | রাজনীতি | views:46 | likes:0 | share: 1 | comments:0

(প্রতিবেদক বক্সা জঙ্গল লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা এবং উত্তরবঙ্গ বন-জন শ্রমজীবী মঞ্চের আহ্বায়ক)

আলিপুদুয়ার জেলা তথা  পশ্চিমবঙ্গের গর্ব বক্সা পাহাড়ের মাথায় সবকটি সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। 

রাজ্যের ৮০০০-এরও বেশি স্কুল বন্ধের খবর ফলাও করে বের হলেও কেউ খেয়ালই করলেন না যে ঐ দুর্গম পাহাড়ের মাথার স্কুলগুলি একই অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া যায় না। সম্প্রতি সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে যেখানে ৩০ বা তার কম শিক্ষার্থী রয়েছে সেগুলো বন্ধ করবার জন্য রাজ্য সরকারের তরফে একটি নোটিশ জারি করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে যেসব সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ৩০ বা তার কম সেইসব বিদ্যালয়গুলিকে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই বন্ধ কেন? এর পেছনে গোপন রহস্য কী? সেগুলো নিয়ে আজ আর নাই বা বললাম, সে পরে হবে। আজ আসুন আমরা আমাদের ঐতিহ্যলালিত, ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত বক্সা পাহাড়ে ঘুরে আসি। বক্সা আমরা যারাই গেছি তারা সান্তালাবাড়ি চিনি। সেই সান্তালাবাড়ি গ্রামের আগে যেখানে একমাত্র সরকারি বাস গিয়ে থামে সেই জায়গাটি হল ২৯ বস্তি। তার পর হেঁটে বা গাড়িতে সান্তালাবাড়ি গিয়ে মমো খেয়ে আবার এগোনো শুরু হবে। এই সান্তালাবাড়ি আর একটি গ্রাম, তারপর সদরবাজার, ডারাগাওঁ, বক্সাফোর্ট, লাল বাংলা, তাসি গাওঁ। পুবের দিকে খাটালাইন হয়ে লেপচাখা, ওছলুম-ছবির মতো গ্রামগুলো। আবার পশ্চিমে চুনাভাটি, নামনা, সেওগাওঁ আর আদমা। এই গ্রামগুলো সবকটিই ফরেস্টের ভেতরে। তা সেখানে যারা থাকে তারাও তো জংলী তাই না! সেই গ্রামগুলোর জন্য অল্প কিছু বছর আগে বরাদ্দ হয়েছিল চারটি ছোট ছোট স্কুলের, তার মধ্যে প্রাথমিক ৩টি আর একটি জুনিয়ার হাই স্কুল। আপনারা সকলেই জানেন গ্রামগুলো খুবই ছোট ছোট, জনসংখ্যা খুবই কম তাই স্বভাবতই ছাত্রসংখ্যাও কম। এবারে ছাত্র সংখ্যা ৩০এর নীচে হলে সেই স্কুল বন্ধ। তাই সবগুলো স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হল। তার নোটিশ এখনো সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে সবার হাতের মুঠোয়। তা বক্সা পাহাড়ের মাথায় নামনা, সেওগাওঁ, আদমা তো ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কি ৩০এর বেশি হওয়া সম্ভব? এই সহজ সরল প্রশ্নটি শিক্ষা দপ্তরের কর্তাদের মাথায় কি আসেনি? নাকি তারা ঐ দূর দুরান্তের স্কুলগুলির ঝামেলা(?) ঝেড়ে ফেলতেই চাইছেন? আর সবকটি স্কুলই বন্ধ করে দিতে হবে। হায় রে! যখন প্রতিটি শিশুর বিদ্যালয়ে পড়বার অধিকার ভারতের সংবিধান দিয়েছে, যখন সবাই চাইছেন সব শিশু বিদ্যালয়মুখী হোক, যখন শিশুদের একটিবেলার খাবার অন্তত নিশ্চিত করতে মিড-ডে মিল চালু করা হয়েছে, তখন একটি বিস্তীর্ণ এলাকার সবকটি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হল। একবারও ভাবলেন না যে ঐ গ্রামগুলির শিশুদের অন্য কোনো বিকল্পই রইল না। 

 ফরেস্ট ভিলেজের মানুষজন যাদের ছাড়া ফরেস্টটাই থাকবে না, তাদের জন্য বনাধিকার আইন প্রস্তুত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে ভারতের সংবিধানে। যদিও তাকে খর্ব করবার জন্যও উঠে পড়ে লেগেছে সরকার। তা ঐ বনের মানুষগুলো, ঐ জংলী(?) মানুষগুলো তাদের খাবার-দাবার কীভাবে পাবে, ন্যূনতম চিকিৎসা কীভাবে পাবে তার ব্যবস্থাই ছিল এই পাহাড়ের এক জ্বলন্ত সমস্যা সেখানে এবার যুক্ত হল তাঁদের বাচ্চাগুলো পড়বার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হবে। আসলে কী সবটা মিলে একটা সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য? মানে সবদিকে থেকে বঞ্চিত করে রাখো যেন নিজেরাই জঙ্গল ছেড়ে পালিয়ে যায়। তাহলেই অবাধে লুঠ করা যাবে জঙ্গল!! 'বাঘ ছাড়া হবে'- সেই ভয় দেখিয়ে, '১০লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে' তার প্রলোভন দেখিয়েও যখন কাজ হল না তখন কি এ এক অভিনব পন্থা? 

আর গত তিনদিনে কোনো মিডিয়াতেই স্থান পায় না এই স্কুলগুলির অবলুপ্তির কথা!এই চক্রান্ত কতটা গভীর! হাতে মারো ভাতে মারো সব দিক থেকে মারো ঐ জংলীগুলোকে। এই চাইছেন! 

৮০০ কি.মি. দূরের রাজধানীতে বসে এ নিয়ম করা খুব সহজ যে ৩০ এর কম ছাত্র-ছাত্রীর স্কুলগুলিকে বন্ধ করে দাও। বাস্তব কঠিন সত্যটি তাদের বুঝতে অসুবিধে হতেও পারে, তাহলে স্থানীয় প্রশাসন! তারা একবারও ভাবলেন না? একটি বারও মনে হল না মানুষগুলি কী করবেন? কোথায় যাবেন? অথচ ভোটের সময় একদিন আগেই টিম পাঠিয়ে ভোট নেবার আশ্রয়স্থল ঐ স্কুলগুলির একটি। সত‍্যি কি বিচিত্র এই দেশ! 

 শিক্ষার অধিকার তো প্রতিটি শিশুরই আছে। তা এবার কোথায় যাবে শিশুগুলি? তাদের কি কোনও বিকল্প ব্যাবস্থা আছে ঐ পাহাড়ের মাথায়? তাহলে পড়া বন্ধ। শিক্ষা বন্ধ। মিড-ডে মিল বন্ধ। থাক অশিক্ষিত হয়ে। এটাই কি চাইছেন প্রকারান্তরে! আমরা খুব গর্ব করি আমার জেলার, আমার রাজ্যের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলির মধ্যে বক্সা পাহাড় একটি। প্রতিবছর সেখানে হাজির হই ১৫ আগস্টের পতাকা ওড়াতে (সরকারি খরচে)! কোটি কোটি টাকা খরচ করে (?) হেরিটেজ রিনোভেশনের নামে বক্সা পাহাড় নিয়ে ব্যবসার বুদ্ধি ঠিক জোগাড় হয়ে যায় আর বাচ্চাগুলো পড়তে পারবে না, সেটা একবারও মাথায় আসে না? বাঃ কি বিচিত্র ভাবনা!

 তপশিলী উপজাতির পশ্চিমবঙ্গের তালিকায় ভুটিয়া, শেরপা, টোটো, ডুকপা, টিবেটান, ইয়েলমো এক সারিতে আছে। তার মধ্যে ডুকপা জনজাতির সবচাইতে বেশি মানুষ বাস করেন এই বক্সা পাহাড়ে। সংখ্যায় তারা কত? ১০০০ বা তার আশেপাশে। এদের পাশে কি দাঁড়াবার কথা ছিল না? না ওদের শিক্ষার ন্যূনতম ব্যাবস্থাটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হল। তাহলে স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা দপ্তর, আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর, অনগ্রসর শ্রেণি কল্যান দপ্তর কাদের কল্যাণে? কী কাজে ব্যস্ত? পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটা জেলায় কী হল তা আজকের বিষয় নয়? এই বক্সা পাহাড়ের বিষয়টি একটু অন্যভাবে দেখাই যেত। না তা হল না। ফরমান বেড়িয়ে গেল স্কুল বন্ধ। 

 এরপর আবার যখন বক্সা পাহাড়ে যাবেন স্ফুর্তি করতে তখন দাঁড়াতে পারবেন তো ঐ মানুষগুলোর সামনে? ওদের বাড়িতে আপনার জন্য রান্না করে দিতে বলতে লজ্জা করবে না? আপনার শিশুটির জন্য খাবার তৈরি করে দিতে বলবেন ওই না পড়তে পারা নিষ্পাপ শিশুদের? আজ একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এই প্রশ্নগুলিই করুন। যদি উত্তর পান...।

সংগ্রহ: http://www.ba.cpiml.net/deshabrati/2023/03/all-schools-will-be-closed-in-buxa-hills

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86933